যেখানে আলপিন থেকে – বুড়িগঙ্গার পাড়েই জিঞ্জিরা। ঢাকার কোল ঘেঁষা কেরানীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ থানার একটি ইউনিয়ন। পুরো জিঞ্জিরাই যেন ভিন্ন মাত্রার এক কারখানা। আলপিন থেকে ‘আইফোন’, সবই তৈরি হয় এখানে। গায়ে মেড ইন জাপান, চায়না লেখা পণ্য তৈরি করে ছাড়া হচ্ছে বাজারে। জিঞ্জিরায় ঢুকতেই কানে আসবে বিভিন্ন ধরনের শব্দ। আসে মেশিনের শব্দ।
এখানে তৈরি হয় পিতলের ও তামার তৈজসপত্র, আলকাতরা, পরিধেয় পোশাক, মেলামাইনের পণ্যসামগ্রী, টিন, নাট, স্ক্রু, তারকাটা, বিভিন্ন ধরনের তার, রশি, ঝাড়ু, দরজা, জানালা, হ্যাসবোল, তালা, দা-বঁটি, শাবল, বালতি, কুড়াল, চাপাতি, কোদাল, বৈদুতিকসামগ্রী, ঘর সাজানোর তৈজসপত্র, বিভিন্ন ধরনের চুলা, রং, বিভিন্ন ভারি মেশিনের যন্ত্রাংশ, গাড়ির যন্ত্রাংশ। যন্ত্রাংশ সংযোজন করে তৈরি হচ্ছে মোবাইল ফোন।
লোশন, ক্রিম, সুগন্ধি তেল, সাবানসহ তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন টয়লেটিজ সামগ্রীও। ওষুধ, শিশুখাদ্যসহ রাসায়নিক বিভিন্ন পণ্য তৈরির কারখানাও আছে এখানে। নির্দিষ্ট কোনো হিসাব না থাকলেও ধারণা করা হয় প্রতি মাসে জিঞ্জিরা থেকে কোটি কোটি টাকার পণ্য ও যন্ত্রাংশ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়। এখানে রয়েছে বড়-ছোট মিলিয়ে প্রায় ৪ হাজার কারখানা।
যেখানে আলপিন থেকে ‘আইফোন’, সবই তৈরি হয়
স্থানীয়দের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদের হাতে পতনের পর তার স্বজনদের আটক করে রাখা হয় বুড়িগঙ্গা পাড়ের একটি প্রাসাদে। নবাবের মা আমেনা বেগম, স্ত্রী লুৎফা বেগম, মেয়ে কুদসিয়া বেগম ওরফে উম্মে জোহরা ও খালা ঘষেটি বেগমের হাতে হাতকড়া বা জিঞ্জির পরিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। সেই জিঞ্জির থেকে প্রাসাদের নাম হয় জিঞ্জিরা প্রাসাদ। আর ধারণা করা হয়, সেই থেকেই এই এলাকার নাম হয় জিঞ্জিরা।\
এই এলাকা বিভিন্ন পণ্য তৈরির নামডাক অনেক আগে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে হওয়ায় পণ্য আনা-নেয়ার সুবিধার পাশাপাশি পুরান ঢাকার বসতি গড়া মানুষদের পণ্য সরবারহ করার উদ্দেশ্যে এই জিঞ্জিরা বাজার গড়ে ওঠে।
আগানগর বাজার এলাকার একটি ছোট কাচঘেরা ঘরে কাজ করছিলেন চার যুবক। তারা মোবাইলের যন্ত্রাংশ কিনে এনে তৈরি করেন মোবাইল ফোন। যা দেখতে হুবহু বাজারের নতুন মোবাইল ফোনের মতো। এমনকি স্টিকার পর্যন্ত দেখে বোঝার উপায় সেই এটি সংযোজন করা। ওই দোকানের একজন শ্রমিক জানান, গতকাল ৮টি ‘আইফোন’ তৈরি করে পাঠিয়েছেন তারা। এখন বাজারের বেশ কিছু মডেলের ফোন তৈরি করছেন। আরেকজন জানান, বাজারে মূলত এমআই, স্যামস্যাং, সিম্ফনি মোবাইল ফোনের চাহিদা বেশি। তাদের কাজের ধরন সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, তারা মূলত অর্ডার পেলে তবেই মোবাইল তৈরি করেন।
একটি ‘আইফোন’ মডেলের ফোন সেটের যন্ত্রাংশ ক্রয় করতে খরচ হয় ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা। আর তারা বিক্রি করেন ৫ থেকে ৮ হাজার টাকায়। এসব মোবাইলের ক্রেতা কারা জানতে চাইলে বলেন, মূলত রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমল থেকেই আসে এর অর্ডার। এরমধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্কসহ প্রায় সব মার্কেট। আবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও তাদের মোবাইল চলে যায়। এসব গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন করলে জানান, গুণগত মানতো খারাপ হবেই। অরিজিনাল যন্ত্রাংশ প্রায় ৯০ ভাগ পরীক্ষিত। আর তাদের যন্ত্রাংশগুলো এখানেই প্রস্তুত হয়। তিনি আরো বলেন, এসব মোবাইল কেনার ২ দিনের মধ্যেও মোবাইলে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বিভিন্ন বৈদুৎিক সামগ্রী তৈরি করে আবেদ ট্রেডার্স। এর স্বত্বাধিকারী আবেদুর রহমান আবেদ বলেন, আমাদের পণ্য বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। আর আমরা এসব পণ্যের গায়ে মেইড ইন চায়না, জাপান, কোরিয়া, হাঙ্গেরি লিখে দিই।
জিঞ্জিরায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন মানিক ব্যাপারী ও তার স্ত্রী ছহুরা ব্যাপারী। একটি তারকাঁটা তৈরির কাজ করেন প্রায় ৬ বছর ধরে। স্বামীর মাসে বেতন ১৫ হাজার টাকা। কাজ পেরেকের আকৃতি দেয়া। আর স্ত্রী পেরেকে গুলতি লাগানোর কাজ করেন। ১ কেজি গুলতি লাগিয়ে পান ২০ টাকা। এভাবে সারা দিনে তার আয় হয় প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এই কারখানায় তারকাঁটার পাশাপাশি জিআই তার তৈরি করা হয়।এই কারখানায় কাজ করেন ২৮ জন শ্রমিক।
প্রায় ২০টি কারখানা ঘুরে মালিক শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সামান্য সহযোগিতা পেলে এই জিঞ্জিরা হয়ে উঠতে পারে দেশের আয়ের একটি বড় উৎস। তারা কোন একটি পণ্য দেখে বানিয়ে ফেলতে পারেন হুবহু।
মোটরসাইকেলের তালা তৈরি করেন রাকিব মিয়া। তিনি একটি তালা দেখিয়ে বলেন, এই তালাগুলো জাপান থেকে নিয়ে আসা হয় বাজারে। দাম পড়ে ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা। এত টাকা খরচ করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি হুবহু এই তালা বানিয়ে দিতে পারবো ৩শ’ টাকায়। অর্ডার পেলে তবেই বানাই। তালার গায়ে লিখতে হয় মেইড ইন চায়না ও অন্য কোম্পানির নাম।
একটি ব্রাশ তৈরির কারখানায় কাগজের লেবেল লাগানোর কাজ করে ১০ বছর বয়সী মিরন। মিরনের বাবা পরিবার ছেড়ে চলে গেছেন। বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা। এখন মা ও মিরনের আয়ে চলে সংসার। মিরন কাজ করতে করতে জানায়, ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক কারণেই ছেড়ে দিতে হয়েছে স্কুল। স্কুলে পড়ার ইচ্ছার কথাও জানায় সে। জিঞ্জিরার আগানগর এলাকায় চায়ের দোকান মালেক মিয়ার। প্রায় ৪০ বছর ধরে এই এলাকায় থাকেন। আগে ছিলেন শ্রমিক এখন দিয়েছেন এই দোকান।
মালেক মিয়ার সঙ্গে আলাপে জানা যায়, আজ থেকে ১০ বছর আগেও এই এলাকা ছিল নকল পণ্যের সম্রাজ্য। তবে এখন নকল পণ্যের আধিক্য অনেকটাই কম। নকল পণ্যের কারিগররা ধীরে ধীরে পুলিশের ও অন্যান্য ব্যবসায়ীর চাপে ছড়িয়ে গেছে। এখন তাদের অবস্থান মূলত পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। তিনি জানান, নকল ওষুধ এখন তৈরি হয় না বললেই চলে। তবে এখনো শতভাগ নির্মুল হয়নি। নকল ওষুধের বিরুদ্ধে পুলিশের জোরালো অবস্থানের কারণে লুকিয়ে অন্য কারখানার ভেতর তৈরি হয় ওষুধ। আর নকল খাবারের বিষয়টিও তাই। এগুলো তৈরি হয় গোপনে।